180 মানুষ নিরোপায় হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে পরিশেষে সারা জীবন ইবাদত কারী সেই শরীকদারীর কথা ভুলে যায় । ডাকতে হবে বিপদ আসার আগে
* আজব স্বভাব, মানুষ বিপদে পরে আল্লাহকে ডাকে,১৭: বনী ইসরাঈল: আয়াত: ৬৭
وَ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فِی الۡبَحۡرِ ضَلَّ مَنۡ تَدۡعُوۡنَ اِلَّاۤ اِیَّاہُ ۚ فَلَمَّا نَجّٰىکُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اَعۡرَضۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ کَفُوۡرًا
* যখন আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দুরীভূত করে দেন, তখনই তোমাদের একদল স্বীয় পালনকর্তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করতে থাকে।নাহল -৫৪
ثُمَّ إِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنكُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنكُم بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ
* যখন তার রব তাকে নিয়ামত দান করেন তখন সে ইতিপূর্বে যে বিপদে পড়ে তাঁকে ডাকছিলো তা ভুলে যায়। আর বলে কাপ্তান নাবিক বরই এক্সপার্ট ছিল । যুমার-৮
وَإِذَا مَسَّ الْإِنسَانَ ضُرٌّ دَعَا رَبَّهُ مُنِيبًا إِلَيْهِ ثُمَّ إِذَا خَوَّلَهُ نِعْمَةً مِّنْهُ نَسِيَ مَا كَانَ يَدْعُو إِلَيْهِ مِن قَبْلُ وَجَعَلَ لِلَّهِ أَندَادًا لِّيُضِلَّ عَن سَبِيلِهِ ۚ قُلْ تَمَتَّعْ بِكُفْرِكَ قَلِيلًا ۖ إِنَّكَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
* আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হতো তাহলে যেসব কথায় তোমরা লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলে সেগুলোর কারণে তোমাদের ওপরে মহাশাস্তি নেমে আসতো। ২৪: আন্-নূর: ১৪
وَ لَوْ لَا فَضْلُ اللّٰهِ عَلَیْكُمْ وَ رَحْمَتُهٗ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِیْ مَاۤ اَفَضْتُمْ فِیْهِ عَذَابٌ عَظِیْمٌۚۖ
* আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি প্রশ্ন করে বলেন। 6:আল-আনয়াম:40-41
قُلْ اَرَءَیْتَكُمْ اِنْ اَتٰىكُمْ عَذَابُ اللّٰهِ اَوْ اَتَتْكُمُ السَّاعَةُ اَغَیْرَ اللّٰهِ تَدْعُوْنَۚ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ
بَلْ اِیَّاهُ تَدْعُوْنَ فَیَكْشِفُ مَا تَدْعُوْنَ اِلَیْهِ اِنْ شَآءَ وَ تَنْسَوْنَ مَا تُشْرِكُوْنَ۠
* আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা এ ধরণের নিশানী প্রত্যক্ষ করেই ঈমানের সম্পদ লাভে সক্ষম হন।
* আবু জাহেলের ছেলে ইকরামার চোখের সামনে আবু জাহেলকে হত্যা করে। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অহুদের যুদ্ধের মাঠে নামে। অহুদের যুদ্ধে সত্তর জন সাহাবী শহীদ হন। সাহাবীদের শহীদ করার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভুমি়কা ছিল আবু জাহেলের ছেলে ইকরামার ও খালেদ বিন ও অলিদের। মক্কা বিজিত হবার পর ইকরামা জেদ্দার দিকে পালিয়ে যান। একটি নৌকায় চড়ে তিনি হাবাশার (ইথিয়োপিয়ার) পথে যাত্রা করেন। পথে ভীষণ ঝড়-তুফানে তার নৌকা চরম বিপদের সম্মুখীন হয়।প্রথমে দেবদেবীদের দোহাই দেয়া শুরু হয়
* ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, যে কিনা উহুদ যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) এর চাচা হামযার কলিজা চিবিয়ে ছিলেন, অন্য আরো প্রায় দশজন মহিলার সাথে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ক্যাম্পে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হল। প্রথমে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা ও পরে ইকরামার স্ত্রী উম্মু হাকীম নিজেকে মুসলিম বলে স্বীকৃতি দেন। ইকরামার জন্য নিরাপত্তা চেয়ে নেন
* ছোট কালে মা ডাক দিয়া বলতো বেত লওয়ার আগে পড়তি বস,আল্লাহ ডাকে বান্দা আযাব আসার আগেই আমার দিকে ফিরে এসো 39: আয-যুমার: 54
وَأَنِيبُوٓا إِلٰى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُۥ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ
* অনুসরণ করো তোমাদের রবের প্রেরিত কিতাবের তোমাদের ওপর আকস্মিকভাবে আযাব আসার পূর্বেই । 39: আয-যুমার:55
وَاتَّبِعُوٓا أَحْسَنَ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
* এমন যেন না হয় যে, পরে কেউ বলবেঃ “আমি আল্লাহর ব্যাপারে যে অপরাধ করেছি সেজন্য আফসোস।39: আয-যুমার:56
أَن تَقُولَ نَفْسٌ يٰحَسْرَتٰى عَلٰى مَا فَرَّطتُ فِى جَنۢبِ اللَّهِ وَإِن كُنتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ
* সে জন্য আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হতে বলেছেন। সময় থাকতে দাখিল হতে হবে। 2: আল-বাক্বারাহ:208
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا ادْخُلُوا فِى السِّلْمِ كَآفَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوٰتِ الشَّيْطٰنِ ۚ إِنَّهُۥ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
* ফেরাউনের উপর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব আসে তখন সে নিরুপায় হয়ে ইমান আনে আল্লাহর দিকে ফিরে,১০: ইউনুস: ৯০
وَ جٰوَزْنَا بِبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ الْبَحْرَ فَاَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَ جُنُوْدُهٗ بَغْیًا وَّ عَدْوًا١ؕ حَتّٰۤى اِذَاۤ اَدْرَكَهُ الْغَرَقُ١ۙ قَالَ اٰمَنْتُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا الَّذِیْۤ اٰمَنَتْ بِهٖ بَنُوْۤا اِسْرَآءِیْلَ وَ اَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ
* ফেরাউনের তৌবাহ কবুল হয়নি। আল্লাহর গজব শূরু হয়ে গেলে তৌবা কবুল হবেনা। 4:আন-নিসা:18
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّـَٔاتِ حَتّٰىٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّى تُبْتُ الْـٰٔنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ ۚ أُولٰٓئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
* জাহান্নামীরা ও বিপদে পরে ডাকবে,ফাতির - ৩৬-৩৭
وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَىٰ عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ
অর্থ- আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ ۚ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُم مَّا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَن تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ ۖ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِن نَّصِيرٍ
অর্থ- সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই।
* আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা এ ধরণের নিশানী প্রত্যক্ষ করেই ঈমানের সম্পদ লাভে সক্ষম হন। নবী সা: এর হাতে মক্কা বিজিত হবার পর ইকরামা জেদ্দার দিকে পালিয়ে যান। একটি নৌকায় চড়ে তিনি হাবাশার (ইথিয়োপিয়ার) পথে যাত্রা করেন। পথে ভীষণ ঝড়-তুফানে তার নৌকা চরম বিপদের সম্মুখীন হয়।প্রথমে দেবদেবীদের দোহাই দেয়া শুরু হয়। কিন্তু এতে তুফানের ভয়াবহতা কমে না বরং আরো বেড়ে যেতেই থাকে। যাত্রীদের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, এবার নৌকা ডুবে যাবে। তখন সবাই বলতে থাকে, এখন আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকলে চলবে না। একমাত্র তিনি চাইলে আমাদের বাঁচাতে পারেন। এ সময় ইকরামের চোখ খুলে যায়। তার মন বলে ওঠে, যদি এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্যকারী না থেকে থাকে, তাহলে অন্য জায়গায়ই বা আর কেউ থাকবে কেন? একথাটাই তো আল্লাহর সেই নেক বান্দাটি আমাদের গত বিশ বছর থেকে বুঝাচ্ছেন আর আমরা খামখা তাঁর সাথে লড়াই করছি। এটি ছিল ইকরামার জীবনের সিদ্ধান্তকরী মুহূর্ত। সে মুহূর্তেই তিনি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেন, যদি এ যাত্রায় আমি বেঁচে যাই, তাহলে সোজা মুহাম্মাদ সা: এর কাছে যাবো এবং তাঁর হাতে আমার হাত দিয়ে দেবো। পরে তিনি নিজের এ অঙ্গীকার পূর্ণ করেন। ফিরে এসে তিনি কেবল মুসলমান হয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং অবশিষ্ট জীবন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করেই কাটান।
______________________________
28 মানুষ নিরোপায় হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে পরিশেষে শরীকদারীর কথা ভুলে যায়
* আজব স্বভাব, মানুষ বিপদে পরে আল্লাহকে ডাকে,১৭: বনী ইসরাঈল: আয়াত: ৬৭
وَ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فِی الۡبَحۡرِ ضَلَّ مَنۡ تَدۡعُوۡنَ اِلَّاۤ اِیَّاہُ ۚ فَلَمَّا نَجّٰىکُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اَعۡرَضۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ کَفُوۡرًا
শব্দার্থ: وَإِذَا = এবং যখন , مَسَّكُمُ = তোমাদের স্পর্শ করে, الضُّرُّ = বিপদ, فِي = মধ্যে, الْبَحْرِ = সাগরের, ضَلَّ = হারিয়েযায়, مَنْ = যাকে , تَدْعُونَ = তোমরা ডাকো, إِلَّا = ছাড়া, إِيَّاهُ = শুধু তিনি ই, فَلَمَّا = অতএব যখন , نَجَّاكُمْ = আমরা উদ্ধারকরি তোমাদের , إِلَى = দিকে, الْبَرِّ = স্থলের, أَعْرَضْتُمْ = মুখফিরাওতোমরা, وَكَانَ = এবং হলো , الْإِنْسَانُ = মানুষ, كَفُورًا = বড়ইঅকৃতজ্ঞ,
অর্থ- যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে, তখন শুধু আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা আহবান করে থাক তাদেরকে তোমরা বিস্মৃত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন, তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।
* যখন আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দুরীভূত করে দেন, তখনই তোমাদের একদল স্বীয় পালনকর্তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করতে থাকে।নাহল 16-54
ثُمَّ إِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنكُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنكُم بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ
শব্দার্থ: ثُمَّ = এরপর, إِذَا = যখন , كَشَفَ = দূরকরেদেন, الضُّرَّ = দুঃখ-দৈন্য, عَنْكُمْ = থেকে তোমাদের , إِذَا = তখন , فَرِيقٌ = একদল, مِنْكُمْ = তোমাদের মধ্য হতে , بِرَبِّهِمْ = সাথে তাদের রবের , يُشْرِكُونَ = (অন্যদেরকে) শরীককরে,
অর্থ- এরপর যখন আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দুরীভূত করে দেন, তখনই তোমাদের একদল স্বীয় পালনকর্তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করতে থাকে।
* যখন তার রব তাকে নিয়ামত দান করেন তখন সে ইতিপূর্বে যে বিপদে পড়ে তাঁকে ডাকছিলো তা ভুলে যায়। কাপ্তান নাবিক বরই এক্সপার্ট ছিল-আয্-যুমার 39-8
وَإِذَا مَسَّ الْإِنسَانَ ضُرٌّ دَعَا رَبَّهُ مُنِيبًا إِلَيْهِ ثُمَّ إِذَا خَوَّلَهُ نِعْمَةً مِّنْهُ نَسِيَ مَا كَانَ يَدْعُو إِلَيْهِ مِن قَبْلُ وَجَعَلَ لِلَّهِ أَندَادًا لِّيُضِلَّ عَن سَبِيلِهِ ۚ قُلْ تَمَتَّعْ بِكُفْرِكَ قَلِيلًا ۖ إِنَّكَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
শব্দার্থ: وَإِذَا = এবং যখন , مَسَّ = স্পর্শ করে, الْإِنْسَانَ = মানুষকে, ضُرٌّ = কোনোদুঃখদৈন্য, دَعَا = সেডাকে, رَبَّهُ = তাররবকে, مُنِيبًا = একাগ্রচিত্তে, إِلَيْهِ = তাঁরদিকে, ثُمَّ = এরপর, إِذَا = যখন , خَوَّلَهُ = তাকেদান করেন , نِعْمَةً = অনুগ্রহ, مِنْهُ = তাঁর পক্ষ হতে , نَسِيَ = সেভুলেযায়, مَا = যার (জন্য) , كَانَ = সে, يَدْعُو = ডাকছিলো, إِلَيْهِ = তারদিকে (একনিষ্ঠভাবে) , مِنْ = হতে, قَبْلُ = পূর্বে, وَجَعَلَ = এবং দাঁড়করায়, لِلَّهِ = আল্লাহর জন্যে , أَنْدَادًا = সমকক্ষ, لِيُضِلَّ = বিভ্রান্তকরেযেন, عَنْ = হতে, سَبِيلِهِ = তাঁরপথ, قُلْ = (হেনাবী) বলো, تَمَتَّعْ = উপভোগকরো, بِكُفْرِكَ = তোমারঅকৃতজ্ঞঅবস্থার (স্বাদ) , قَلِيلًا = কিছুক্ষণ, إِنَّكَ = তুমি নিশ্চয়ই, مِنْ = অন্তর্ভুক্ত, أَصْحَابِ = অধিবাসীদের, النَّارِ = জাহান্নামের,
অর্থ- মানুষের ওপর যখন কোন বিপদ আসে তখন সে তার রবের দিকে ফিরে যায় এবং তাঁকে ডাকে। কিন্তু যখন তার রব তাকে নিয়ামত দান করেন তখন সে ইতিপূর্বে যে বিপদে পড়ে তাঁকে ডাকছিলো তা ভুলে যায় এবং অন্যদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করতে থাকে যাতে তারা আল্লাহর পথ থেকে তাকে গোমরাহ করে। (হে নবী! ) তাকে বলো, তোমার কুফরী দ্বারা অল্প কিছুদিন মজা করে নাও। নিশ্চিতভাবেই তুমি দোজখে যাবে।
* আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হতো তাহলে যেসব কথায় তোমরা লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলে সেগুলোর কারণে তোমাদের ওপরে মহাশাস্তি নেমে আসতো। ২৪: আন্-নূর: ১৪
وَ لَوْ لَا فَضْلُ اللّٰهِ عَلَیْكُمْ وَ رَحْمَتُهٗ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِیْ مَاۤ اَفَضْتُمْ فِیْهِ عَذَابٌ عَظِیْمٌۚۖ
শব্দার্থ: وَلَوْلَا = আরযদিনা (হতো) , فَضْلُ = অনুগ্রহ, اللَّهِ = আল্লাহর, عَلَيْكُمْ = তোমাদের উপর , وَرَحْمَتُهُ = ওতাঁরদয়া, فِي = মধ্যে, الدُّنْيَا = দুনিয়ার, وَالْآخِرَةِ = ওআখিরাতে, لَمَسَّكُمْ = অবশ্যই তোমাদের কে স্পর্শ করতো, فِي = মধ্যে, مَا = যার, أَفَضْتُمْ = তোমরা জড়িয়েপড়েছিলে, فِيهِ = সেক্ষেত্রে, عَذَابٌ = শাস্তি, عَظِيمٌ = কঠিন,
অর্থ- যদি তোমাদের প্রতি দুনিয়ায় ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হতো তাহলে যেসব কথায় তোমরা লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলে সেগুলোর কারণে তোমাদের ওপরে মহাশাস্তি নেমে আসতো।
* আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি প্রশ্ন করে বলেন। 6:আল-আনয়াম:40-41
قُلْ اَرَءَیْتَكُمْ اِنْ اَتٰىكُمْ عَذَابُ اللّٰهِ اَوْ اَتَتْكُمُ السَّاعَةُ اَغَیْرَ اللّٰهِ تَدْعُوْنَۚ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ
শব্দার্থ: قُلْ = বলো, أَرَأَيْتَكُمْ = কি তোমরা (ভেবে) দেখেছো, إِنْ = যদি, أَتَاكُمْ = কাছে আসে তোমাদের , عَذَابُ = শাস্তি, اللَّهِ = আল্লাহর, أَوْ = বা, أَتَتْكُمُ = কাছে আসে তোমাদের , السَّاعَةُ = ক্বিয়ামাত, أَغَيْرَ = (তবে) কিছাড়া, اللَّهِ = আল্লাহ, تَدْعُونَ = ডাকবে তোমরা (অন্যকাউকে) , إِنْ = যদি, كُنْتُمْ = হও তোমরা , صَادِقِينَ = সত্যবাদী (তবেউত্তরদাও) ,
অর্থ- এদেরকে বলো, একটু ভেবে চিন্তে বলতো দেখি, যদি তোমাদের ওপর কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বড় রকমের বিপদ এসে পড়ে অথবা শেষ সময় এসে যায়, তাহলে সে সময় কি তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকো? বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
আনয়াম:41
بَلْ اِیَّاهُ تَدْعُوْنَ فَیَكْشِفُ مَا تَدْعُوْنَ اِلَیْهِ اِنْ شَآءَ وَ تَنْسَوْنَ مَا تُشْرِكُوْنَ۠
শব্দার্থ: بَلْ = (না) বরং, إِيَّاهُ = শুধু তাঁকেই, تَدْعُونَ = ডাকো তোমরা , فَيَكْشِفُ = অতঃপর তিনি দূর করেন , مَا = যেজন্য, تَدْعُونَ = তোমরা ডাকো ( দুআ করো) , إِلَيْهِ = কাছে তাঁর, إِنْ = যদি, شَاءَ = তিনি ইচ্ছে করেন , وَتَنْسَوْنَ = এবং ( তখন ) তোমরা ভুলেযাও, مَا = যাকে , تُشْرِكُونَ = তোমরা শিরককরেথাকো,
অর্থ- তখন তোমরা একমাত্র আল্লাহকেই ডেকে থাকো। তারপর তিনি চাইলে তোমাদেরকে সেই বিপদমুক্ত করেন। যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক করতে তাদের কথা এ সময় একদম ভুলে গিয়ে থাকো।২৯
* আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা এ ধরণের নিশানী প্রত্যক্ষ করেই ঈমানের সম্পদ লাভে সক্ষম হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে মক্কা বিজিত হবার পর ইকরামা জেদ্দার দিকে পালিয়ে যান। একটি নৌকায় চড়ে তিনি হাবাশার (ইথিয়োপিয়ার) পথে যাত্রা করেন। পথে ভীষণ ঝড়-তুফানে তার নৌকা চরম বিপদের সম্মুখীন হয়।প্রথমে দেবদেবীদের দোহাই দেয়া শুরু হয়। কিন্তু এতে তুফানের ভয়াবহতা কমে না বরং আরো বেড়ে যেতেই থাকে। যাত্রীদের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, এবার নৌকা ডুবে যাবে। তখন সবাই বলতে থাকে, এখন আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকলে চলবে না। একমাত্র তিনি চাইলে আমাদের বাঁচাতে পারেন। এ সময় ইকরামের চোখ খুলে যায়। তার মন বলে ওঠে, যদি এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্যকারী না থেকে থাকে, তাহলে অন্য জায়গায়ই বা আর কেউ থাকবে কেন? একথাটাই তো আল্লাহর সেই নেক বান্দাটি আমাদের গত বিশ বছর থেকে বুঝাচ্ছেন আর আমরা খামখা তাঁর সাথে লড়াই করছি। এটি ছিল ইকরামার জীবনের সিদ্ধান্তকরী মুহূর্ত। সে মুহূর্তেই তিনি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেন, যদি এ যাত্রায় আমি বেঁচে যাই, তাহলে সোজা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাবো এবং তাঁর হাতে আমার হাত দিয়ে দেবো। পরে তিনি নিজের এ অঙ্গীকার পূর্ণ করেন। ফিরে এসে তিনি কেবল মুসলমান হয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং অবশিষ্ট জীবন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করেই কাটান।
* ছোট কালে মা ডাক দিয়া বলতো বেত লওয়ার আগে পড়তি বস,আল্লাহ ডাকে আযাব আসার আগেই আমার দিকে ফিরে এসো 39: আয-যুমার: 54
وَأَنِيبُوٓا إِلٰى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُۥ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ
শব্দার্থ: وَأَنِيبُوا = এবং তোমরা অভিমুখীহও, إِلَىٰ = দিকে, رَبِّكُمْ = তোমার রবের, وَأَسْلِمُوا = এবং তোমরা আত্মসমর্পণকরো, لَهُ = তাঁর কাছে , مِنْ = মধ্য হতে , قَبْلِ = (এর) পূর্বে, أَنْ = যে, يَأْتِيَكُمُ = তোমাদের উপর আসবে , الْعَذَابُ = শাস্তি, ثُمَّ = এরপর, لَا = না, تُنْصَرُونَ = তোমাদের সাহায্য করা হবে ,
অর্থ- ফিরে এসো তোমাদের রবের দিকে এবং তাঁর অনুগত হয়ে যাও তোমাদের ওপর আযাব আসার পূর্বেই। তখন কোন দিক থেকেই আর সাহায্য পাওয়া যাবে না।
* অনুসরণ করো তোমাদের রবের প্রেরিত কিতাবের তোমাদের ওপর আকস্মিকভাবে আযাব আসার পূর্বেই । 39: আয-যুমার:55
وَاتَّبِعُوٓا أَحْسَنَ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
শব্দার্থ: وَاتَّبِعُوا = এবং অনুসরণ করো, أَحْسَنَ = উত্তম, مَا = যা, أُنْزِلَ = অবতীর্ণ করাহয়েছে, إِلَيْكُمْ = তোমাদের প্রতি, مِنْ = পক্ষ হতে , رَبِّكُمْ = তোমাদের রবের , مِنْ = থেকে, قَبْلِ = (এর) পূর্বে, أَنْ = যে, يَأْتِيَكُمُ = তোমাদের উপর আসবে , الْعَذَابُ = শাস্তি, بَغْتَةً = হঠাৎ, وَأَنْتُمْ = যখন তোমরা , لَا = না, تَشْعُرُونَ = টেরইপাবে,
অর্থ- আর অনুসরণ করো তোমাদের রবের প্রেরিত কিতাবের সর্বোত্তম দিকগুলোর৭২ ---তোমাদের ওপর আকস্মিকভাবে আযাব আসার পূর্বেই ---যে আযাব সম্পর্কে তোমরা অনবহিত থাকবে।
* এমন যেন না হয় যে, পরে কেউ বলবেঃ “আমি আল্লাহর ব্যাপারে যে অপরাধ করেছি সেজন্য আফসোস।39: আয-যুমার:56
أَن تَقُولَ نَفْسٌ يٰحَسْرَتٰى عَلٰى مَا فَرَّطتُ فِى جَنۢبِ اللَّهِ وَإِن كُنتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ
শব্দার্থ: أَنْ = (এমননাহয়) যে, تَقُولَ = বলে, نَفْسٌ = কেউ, يَاحَسْرَتَا = হায়!, عَلَىٰ = (এর) উপর , مَا = যা, فَرَّطْتُ = আমি অবহেলাকরেছি, فِي = ক্ষেত্রে, جَنْبِ = কর্তব্যের, اللَّهِ = আল্লাহর (প্রতি) , وَإِنْ = এবং নিশ্চয়ই, كُنْتُ = আমি ছিলাম, لَمِنَ = অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত, السَّاخِرِينَ = বিদ্রুপকারীদের ,
অর্থ- এমন যেন না হয় যে, পরে কেউ বলবেঃ “আমি আল্লাহর ব্যাপারে যে অপরাধ করেছি সেজন্য আফসোস। বরং আমি তো বিদ্রূপকারীদের মধ্যে শামিল ছিলাম।”
* সে জন্য আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হতে বলেছেন। সময় থাকতে দাখিল হতে হবে। 2: আল-বাক্বারাহ:208
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا ادْخُلُوا فِى السِّلْمِ كَآفَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوٰتِ الشَّيْطٰنِ ۚ إِنَّهُۥ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
শব্দার্থ: يَاأَيُّهَا = ওহে, الَّذِينَ = যারা, آمَنُوا = ঈমান এনেছো, ادْخُلُوا = তোমরা প্রবেশ করো, فِي = মধ্যে, السِّلْمِ = ইসলামের, كَافَّةً = সম্পূর্ণভাবে, وَلَا = এবং না , تَتَّبِعُوا = তোমরা অনুসরণ করো, خُطُوَاتِ = পদাঙ্কগুলোর, الشَّيْطَانِ = শয়তানের, إِنَّهُ = সে নিশ্চয়ই , لَكُمْ = তোমাদের জন্যে , عَدُوٌّ = শত্রু, مُبِينٌ = প্রকাশ্য,
অনুবাদ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।
* ফেরাউনের উপর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব আসে তখন সে নিরুপায় হয়ে ইমান আনে আল্লাহর দিকে ফিরে,১০: ইউনুস: ৯০
وَ جٰوَزْنَا بِبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ الْبَحْرَ فَاَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَ جُنُوْدُهٗ بَغْیًا وَّ عَدْوًا١ؕ حَتّٰۤى اِذَاۤ اَدْرَكَهُ الْغَرَقُ١ۙ قَالَ اٰمَنْتُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا الَّذِیْۤ اٰمَنَتْ بِهٖ بَنُوْۤا اِسْرَآءِیْلَ وَ اَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ
শব্দার্থ: وَجَاوَزْنَا = এবং পারকরালামআমরা , بِبَنِي = সহ সন্তানদের , إِسْرَائِيلَ = ইসরাঈলের, الْبَحْرَ = সাগর, فَأَتْبَعَهُمْ = অতঃপর পিছনেধাওয়াকরলোতাদের , فِرْعَوْنُ = ফিরাউন, وَجُنُودُهُ = ওসৈন্যবাহিনীতার, بَغْيًا = সীমা লঙ্ঘন , وَعَدْوًا = এবং শত্রুতাবশতঃ, حَتَّىٰ = এমনকি, إِذَا = যখন , أَدْرَكَهُ = পেলোতাকে, الْغَرَقُ = ডুবেযাওয়া (অর্থাৎসাগরেডুবেযাচ্ছিলো) , قَالَ = সে বললো, آمَنْتُ = আমি ঈমান আনলাম, أَنَّهُ = এই (বলে) যে, لَا = নেই, إِلَٰهَ = কোনোইলাহ, إِلَّا = ( তিনি ) ছাড়া, الَّذِي = যিনি (সেইসত্ত্বা) , آمَنَتْ = ঈমান এনেছে, بِهِ = উপর তার, بَنُو = সন্তানরা, إِسْرَائِيلَ = ইসরাঈলের, وَأَنَا = এবং আমি , مِنَ = অন্তর্ভুক্ত, الْمُسْلِمِينَ = আত্মসমর্পনকারীদের (অর্থাৎমুসলমানদের) ,
অর্থ- আর আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করে নিয়ে গেলাম। তারপর ফেরাউন ও তার সেনাদল জুলুম নির্যাতন ও সীমালঙ্ঘন করার উদ্দেশ্য তাদের পেছনে চললো। অবশেষে যখন ফেরাউন ডুবতে থাকলো তখন বলে উঠলো, আমি মেনে নিলাম, বনী ইসরাঈল যার উপর ঈমান এনেছে, তিনি ছাড়া আর কোন প্রকৃত ইলাহ নেই এবং আমিও আনুগত্যের শির নতকারীদের অন্তর্ভুক্ত।
* ফেরাউনের তৌবাহ কবুল হয়নি। আল্লাহর গজব শূরু হয়ে গেলে তৌবা কবুল হবেনা। 4:আন-নিসা:18
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّـَٔاتِ حَتّٰىٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّى تُبْتُ الْـٰٔنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ ۚ أُولٰٓئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
শব্দার্থ: وَلَيْسَتِ = এবং নয়, التَّوْبَةُ = তওবা, لِلَّذِينَ = (তাদের ) জন্য যারা, يَعْمَلُونَ = কাজকরে, السَّيِّئَاتِ = পাপের, حَتَّىٰ = এমনকি, إِذَا = যখন , حَضَرَ = উপস্থিত হয়, أَحَدَهُمُ = কারও তাদের , الْمَوْتُ = মৃত্যু, قَالَ = সেবলে, إِنِّي = আমি নিশ্চয়ই , تُبْتُ = তওবাকরছি, الْآنَ = এখন, وَلَا = এবং নয়, الَّذِينَ = (তাদের জন্যও) যারা, يَمُوتُونَ = মারাযায়, وَهُمْ = তারা এ অবস্থায় যে, كُفَّارٌ = কাফির, أُولَٰئِكَ = ঐসবলোক, أَعْتَدْنَا = আমরা তৈরীকরেরেখেছি, لَهُمْ = তাদের জন্য, عَذَابًا = আজাব, أَلِيمًا = বড়যন্ত্রণাদায়ক,
অর্থ- কিন্তু তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা খারাপ কাজ করে যেতেই থাকে, এমন কি তাদের কারো মৃত্যুর সময় এসে গেলে সে বলে, এখন আমি তাওবা করলাম। অনুরূপভাবে তাওবা তাদের জন্যও নয় যারা মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কাফের থাকে। এমন সব লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছি।২৭
* জাহান্নামীরা ও বিপদে পরে ডাকবে,ফাতির -35: 36-37
وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَىٰ عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ
শব্দার্থ: وَالَّذِينَ = এবং যারা , كَفَرُوا = অবিশ্বাস করেছে, لَهُمْ = তাদের জন্যে (রয়েছে) , نَارُ = আগুন, جَهَنَّمَ = জাহান্নামের, لَا = না, يُقْضَىٰ = আদেশদেয়া হবে (মৃত্যু) , عَلَيْهِمْ = তাদের উপর , فَيَمُوتُوا = যেতারা মরবে, وَلَا = আর না, يُخَفَّفُ = হাল্কাকরা হবে , عَنْهُمْ = তাদের থেকে, مِنْ = কিছু, عَذَابِهَا = তারশাস্তি, كَذَٰلِكَ = এরূপে, نَجْزِي = প্রতিফল দিই আমরা , كُلَّ = প্রত্যেকে, كَفُورٍ = অকৃতজ্ঞকে,
অর্থ- আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ ۚ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُم مَّا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَن تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ ۖ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِن نَّصِيرٍ
শব্দার্থ: وَهُمْ = এবং তারা , يَصْطَرِخُونَ = চিৎকারকরেবলবে, فِيهَا = তার মধ্যে , رَبَّنَا = হেআমাদেররব, أَخْرِجْنَا = আমাদেরকেবেরকরুন, نَعْمَلْ = আমরা কাজ করবো , صَالِحًا = সৎ, غَيْرَ = (তাহতে) ভিন্নতর, الَّذِي = যা, كُنَّا = আমরা , نَعْمَلُ = করতেছিলাম, أَوَلَمْ = (বলা হবে ) নিকি, نُعَمِّرْكُمْ = তোমাদের আমরা আয়ুবৃদ্ধিকরেছি, مَا = যাতে, يَتَذَكَّرُ = শিক্ষা গ্রহণ করতে, فِيهِ = তার মধ্যে , مَنْ = কেউ, تَذَكَّرَ = শিক্ষানিতে (চাইলে) , وَجَاءَكُمُ = এবং তোমাদের ( কাছে ) এসেছিলেন, النَّذِيرُ = সতর্ককারী , فَذُوقُوا = সুতরাং তোমরা স্বাদনাও, فَمَا = অতঃপর নাই, لِلظَّالِمِينَ = সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্যে , مِنْ = কোনো, نَصِيرٍ = সাহায্যকারী,
অর্থ- সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই।
* ইকরামা ইবন আবু জাহেল (রাঃ) এর জীবনী (দুশমন থেকে দোস্ত)
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাহাবা হবার সৌভাগ্য যারা লাভ করেছেন কুরআনে বর্ণিত আয়াতের প্রেক্ষিতে তাদের নামের সাথে একটি বিশেষণ তৎপরবর্তি কালের স্কলারগণ যুক্ত করেছেন যা হলো ‘রাদিআল্লাহু আনহু’, যে কথাটার অর্থ হলো আল্লাহ্ যার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। এই বিশেষণটি যে একদিন ইকরামার জন্য প্রযোজ্য হবে তা ছিল অসম্ভব কল্পনার মতো। তার বাবার নাম হলো আবু জাহল্, যে লোকটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলো ইসলামের প্রধান শত্রু। বাবার মতোই ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে শত্রুতায় আর সকলের চেয়েই অগ্রগামী ছিলো ইকরামা (কিংবা ইকরিমা, দুটিই তাকে ডাকা হতো)- যার অত্যাচারে মুসলিমদের ক্রন্দন অবিশ্বাসীদের মনেও কাঁপন ধরিয়েছে, যে ব্যক্তিটির জন্য মুসলিম বাহিনী উহুদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, যার ঘোর শত্রুতা ও ইসলাম বিরোধিতার জন্য মক্কা বিজয়ের পরও তাকে ক্ষমার জন্য অযোগ্য ঘোষনা করা হয়েছিলো, একদিন সে ব্যক্তিটিই তার জীবন ও সম্পদের সবটুকুই ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন আল্লাহ্ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন।
ইকরিমার বয়স যখন সবেমাত্র ত্রিশ পেরিয়েছে, তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেছেন। আরবের বিশাল অঞ্চল জুড়ে যে কয়েকটি বড় গোত্র বংশ, সম্মান ও মর্যাদায় সবার উপর ছিল তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল কুরাইশ। এই কুরাইশের ভেতরেও ছিলো আরো বেশ কয়েকটি উপগোত্র। সমস্ত কুরাইশ গোত্রের নেতৃস্থানীয় যে দু-তিনটি উপগোত্র ছিলো, ইকরামা ছিলো তেমনই একটি গোত্রের সন্তান। একই ভাবে ধন সম্পদের দিক থেকেও ইকরিমার পরিবার ছিল বিখ্যাত। ইকরিমার মতই উচ্চবংশ ও উচ্চমর্যাদার যে সকল তরুণ মক্কায় ছিল, তাদের মধ্যে সা’দ ইবন্ আবি ওয়াক্কাস্, মুসআ’ব ইবন্ উমাইর এর মত অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইকরিমাও হয়ত এ বন্ধুদের মত শুরুতেই ইসলামে প্রবেশ করতে পারতো, কিন্তু পারেনি তার বাবা আবু জাহল্ বলেই। আবু জাহলের অত্যাচার প্রথম দিককার মুসলিমদের ভীষণ পরীক্ষায় ফেলেছিল এবং অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। যে লোকটি ইসলামের প্রথম শত্রু ছিল, তার সাথে সাথেই ইসলাম বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে ইকরিমা বিন আবি জাহলের তারুণ্যের দিনগুলো কাটতে লাগলো। ইসলামের বিস্ময়কর উত্থান তার এবং তার বাবার নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো, সেজন্য ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য ইকরিমা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। বাবা এবং ইসলামের অন্যান্য শত্রুদের সাথে মিলে দুর্বল ও অসহায় নব্য মুসলিমদের প্রতি অত্যাচার তার প্রতিদিনকার কর্ম হয়ে দাঁড়ালো।
আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সাঃ) একদিন এদেরই অত্যাচারে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন। অবশেষে একদিন বদর প্রন্তরে মক্কার মুশরিকদের সাথে কোন প্রথম কোন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। আবু জাহল তখন মুশরিক দলের নেতৃত্বে। লাত, মানাত, উজ্জা ও আর সকল দেব দেবীর নামে সে শপথ করলো, মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস না করে সে মক্কায় ফিরবে না। বদর প্রন্তরেই সে এসব দেব-দেবীর নামে তিনটি উট বলীদান করল। আকন্ঠ্য সুরাপান আর নারীদের গান আর নাচের মাধ্যমে সে তার সেনাদলকে উদ্দীপ্ত করে চলল।
যুদ্ধ শুরু হলো। আবু জাহল কিছুক্ষণের ভেতরই মুয়াজ ও মুওয়াইবিজ নামের অল্পবয়স্ক দুজন আনসারী মুসলিম তরুণের হাতে ধরাশায়ী হয়ে মৃত্যুবরণ করলো। ইকরিমা দূর থেকে বাবার এ করুণ পরিণতি দেখেছিলো। মৃত্যুকালে তার বাবার শেষ চীৎকার তার অন্তরকে বিদ্ধ করলো, যদিও প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যে তার কিছুই করার ছিল না। পরাজয় আর পিতা হারানোর বেদনা নিয়ে মক্কায় ফিরে এল ইকরিমা।
সেদিন থেকেই পরাজয় আর পিতৃহত্যার প্রতিশোধের ভীষণ আগুন ইকরিমার মনে জ্বলতে শুরু করেছিলো। ইকরিমার মত আর যারা মক্কায় তাদের পিতা বা নিকটাত্বীয়কে হারিয়েছিল, তারাও রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। এভাবেই একদিন মুসলিমদের সাথে কাফিরদের দ্বিতীয় যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল এবং দুপক্ষ মুখোমুখী হলো উহুদ প্রান্তরে।
উহুদের যুদ্ধে ইকরিমা একটি বিরাট অশ্বারোহী দলের নেতৃত্বে ছিলো। এ যুদ্ধে ইকরিমাকে সঙ্গ দেবার জন্য সাথে ছিলো তার স্ত্রী উম্মু হাকীম এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে মিলে সউম্মু হাকীম কুরাইশ সেনাদলকে বাদ্য বাজিয়ে, চীৎকার করে উত্তেজিত করে চলছিলো।
কুরাইশ বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্বে ছিলো খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং বাম বাহুর নেতৃত্বে ছিলো ইকরিমা। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুসলিমদের প্রবল আক্রমনের মুখে কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে গেল এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলিমদের একটি দলকে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অনড় থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যালী পাহারা দেবার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন এবং কোন অবস্থাতেই সে স্থান ত্যাগ না করার জন্য আদেশ করেছিলেন। কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে যাবার পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভের আশায় এ দলটির অধিকাংশ সদস্য রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। আরবের বিখ্যাত সমর কুশলী এবং ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু ইকরিমা এবং খালিদ মুসলিমদের এ স্থানচ্যুতির সুযোগে পেছন থেকে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমন করে বসলো এবং মুষ্টিমেয় যে কজন মুসলিম রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ মেনে সে স্থানটি পাহারা দিচ্ছিল তাদের হত্যা করে মুসলিম বাহিনীকে অপ্রত্যাশিত আক্রমনে বিপর্যস্ত করে ফেললো। তার ফলেই কুরাইশ বাহিনী প্রতিআক্রমন করলো মুসলিম বাহিনীকে এবং বিপুল সংখ্যক অকুতোভয় সাহাবী দৃঢ়পদ থেকে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। মুসলিমদের এ পরাজয় বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসাবে ধরে নিয়ে কুরাইশ বাহিনী মক্কায় ফিরে এল।
উহুদের পর মুসলিমদের শেষ দেখে নেবার জন্য আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী নিয়ে কুরাইশ সেনাদল ইহুদীদের সহায়তা নিয়ে মদিনা আক্রমন করতে এগিয়ে এলো। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর পেয়ে সালমান আল ফারসী নামের অনারব পার্শিয়ান সাহাবীর পরামর্শে আগেই মদীনার প্রবেশমুখে বিশাল পরিখা খনন করে কুরাইশ বাহিনীকে অত্যন্ত হতচকিত করেন ও চমকে দেন। মদীনার প্রবেশমুখে বাধা পেয়ে মুশরিক সেনাদল মদিনা অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবরোধ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। মুশরিক বাহিনীর রসদ ও মনোবল ধীরে ধীরে ক্ষয়ে আসা শুরু হয়। সেনাদলের এ অবস্থা দেখে সুচতুর ইকরামা পরিখার একটি যায়গায় একটি সরু পথ খুঁজে বের করেন। দুঃসাহসিক এক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি একদিন ওই স্থানটি দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে বসেন। কুরাইশদের একটি ক্ষুদ্র দল এ অভিযানে তার অনুগামী হয়। অচিরেই অকুতোভয় এবং অদম্য মনোবলের মুসলিম একদল রক্ষীর হাতে এ দলটির একজন প্রাণ হারায়, কিন্তু ইকরিমা দ্রুতই নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে সে স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হন।
সময় বয়ে যায়। মানুষ বুঝতে পারে সত্য দ্বীন এসে গেছে, আর বসে থাকা যায় না। একে একে ইকরিমার ঘনিষ্ট বন্ধু খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস্ সহ অধিকাংশই মক্কা ত্যাগ করে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো, কিন্তু ইকরিমা তার লক্ষ্যে অবিচল। যেভাবেই হোক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও মুহুম্মাদের শেষ সে দেখে ছাড়বে।
হিজরতের নয় বছর পর রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) দশ হাজার জানবাজ মুসলিমের বিরাট বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে মক্কা বিজয়ের জন্য মক্কার দ্বারপ্রন্তে উপস্থিত হলেন। কুরাইশ দলের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান অবস্থা বেগতিক দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় মুসলিম টহল দলের হাতে ধরা পড়লেন। ধরা পড়ার পর তাকে হত্যা কিংবা জিম্মি না করে ক্ষমা করে দেয়ায় তিনি নিজেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষনা দিয়ে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে মিলে গেলেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর সেনাদলকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সাধারণ কুরাইশ, নারী ও শিশু, এছাড়া আর যারা যুদ্ধ হতে পেছনে থাকবে তাদের একজনকেও আক্রমন না করতে আদেশ করলেন। এ ছিলো পৃথিবীর সমর ইতিহাসে একটি একক ও অনন্য ঘটনা। মক্কার বিভিন্ন প্রবেশপথে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বিভিন্ন কৌশলী সাহাবীর নেতৃত্বে সেনাদল পাঠালেন আর এমনি এক সেনাদলের নেতৃত্বে ছিল খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ, যে কিছুদিন আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। যদিও মক্কার অধিকাংশ লোক এবং যোদ্ধা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর আগমন নিরবে মেনে নিল, তবু ইকরিমা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মুসলিমদের যেভাবেই হোক প্রতিহত করবেন। বিশ্বস্ত কিছু সৈন্য সাথে নিয়ে কুরাইশদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ইকরিমা মুসলিম বাহিনীর বিরোধিতায় অটল থাকলেন। ক্ষুদ্র সে বাহিনী নিয়ে মুখোমুখি হলেন খালিদের নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম বাহিনীর । একসময় যে দুজন ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু, একসাথে যুদ্ধ করেছেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে, আজ সেই খালিদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধরলেন। অন্যদিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ, যাঁকে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তলোয়ার উপাধীতে ভূষিত করেছিলেন, তাঁর নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম বাহিনী অল্পক্ষনের মধ্যেই পরাজিত করলো ইকরিমার বাহিনীকে। মুশরিকদলের অনেকে নিহত হলো এবং বাকীরা কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচলো। যারা পালিয়ে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে একজন হলেন ইকরিমা।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ঐতিহাসিক অভিযানে একমাত্র ইকরিমার সেনাদলের সাথেই মুসলিমদের সংঘাত ও রক্তপাত হয়েছিল। বাকী সব অংশ দিয়ে আল্লাহর রাসুল সাঃ নির্বিঘ্নে প্রবেশ করলেন। একদিন যে মাটি থেকে তাঁকে তাঁর নিজ বংশীয় লোকজন অমানুষিক অত্যাচার করে বিতাড়িত করেছিল, বার বার যে লোকগুলো তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো, তাঁর মাথার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে দুর্ধর্ষ খুনিদের লেলিয়ে দিয়েছিলো, আজ তাদেরই মাঝে তিনি বিজয়ীর বেশে উপস্থিত। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) পৃথিবীর সমর ইতিহাসে সেরা ক্ষমা ও দয়ার নজির প্রদর্শন করলেন। তিনি ঘোষনা করলেন, সকল নারী ও শিশু নিরাপদ, যারা নিজ ঘরে অথবা কাবাগৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ান এর গৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ। এভাবে তাঁর ঘোষনার মাধ্যমে প্রায় সমস্ত মক্কাবাসী নিরাপত্তা লাভ করল। তবে সাধারাণ ক্ষমার মধ্যে থেকেও তিনি কয়েকজন চিহ্নিত লোকের নাম বললেন, যাদের ক্ষমার অযোগ্য ঘোষনা দিয়েছিলেন, এবং এই এর শীর্ষ ব্যক্তিটির নাম ছিল ইকরিমা ইবন্ আবু জাহল। ইকরিমার কানে যখন এ ঘোষণা পৌঁছাল তখন তিনি দ্রুত মক্কার সীমানা অতিক্রম করে ইয়ামেনের দিকে পালানোর জন্য ঘোড়া ছুটালেন।
ইতিমধ্যে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, যে কিনা উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর চাচা হামযার কলিজা চিবিয়ে কুখ্যাত ছিলেন, অন্য আরো প্রায় দশজন মহিলার সাথে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ক্যাম্পে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হল। ক্যাম্পে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দুজন স্ত্রী, তাঁর মেয়ে ফাতিমা এবং আবদুল মুত্তালিব এর পরিবারের কয়েকজন মহিলা তখন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে ছিল। উপস্থিত মহিলাদের দলটির মধ্যে কেবল হিন্দাই কথা বলবে বলে স্থির করে তারা এসেছিলো। উহুদের সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য হিন্দা অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত ছিলো। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে সে নিজের মুখ ঢেকে হাজির হল।
নিজেকে আড়াল রেখে হিন্দা বলে চলল- ”আল্লাহর রাসুল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি ইসলামকে নিজের মনোনীত দীন হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। আপনি সম্পর্কের দিক থেকে আমার নিকটাত্মীয়। আমি আপনার কাছে এজন্য ক্ষমা ও উত্তম ব্যবহারের আশা করছি। আজ থেকে আমি নিজেকে বিশ্বাসী মুমিনদের একজন বলে ঘোষনা করছি, যে আল্লাহ্ যে সত্য মিশন সহ আপনাকে পাঠিয়েছেন, তা দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে।”
এ কথা বলার পর হিন্দা নিজের মুখ থেকে নিকাব সরিয়ে ফেলে বলল “আমি হিন্দা বিনত্ উৎবা ইয়া রাসুলুল্লাহ্”।
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বললেন, ”তোমাকে স্বাগতম।”
হিন্দা বলে চলল ”আল্লাহর শপথ হে আল্লাহর রাসুল, আজকের আগে পৃথিবীর কোন ঘর আমার কাছে আপনার ঘরের চেয়ে অপছন্দনীয় ছিল না, আর আজ এখন থেকে পৃথিবীর কোন ঘর আপনার ঘরের চেয়ে প্রিয় আর মর্যাদাপূর্ণ নেই।”
এবার আকস্মিকভাবেই উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ইসলামে প্রবেশের ঘোষনা দিয়ে বললেন, ”ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আপনি তাকে পেলে হত্যা করবেন এই ভয়ে ইকরামা মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন এর দিকে চলে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন, তাহলে আল্লাহ্ও আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন।”
”সে নিরাপদ”, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অঙ্গীকার করলেন।
উম্মু হাকীম এক মুহূর্তও দেরী করলেন না, তখনই বেরিয়ে পড়লেন ইকরিমার খোঁজে ইয়ামেনের পথে। তার সাথে একজন গ্রীক কৃতদাসকে সঙ্গে নিলেন নিজ নিরাপত্তার জন্য। পথিমধ্যে তাঁরা যখন নির্জন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সে দাসটি জোর করে তাকে শ্লীলতাহানী করতে চাইলো। কিন্তু উম্মু হাকীম কৌশলে তাকে কোন আরব লোকালয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন। লোকালয়ে পৌঁছানোর পরই উম্মু হাকীম সেখানকার অধিবাসীদের সব জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। তারা দ্রুত তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল এবং গ্রীক কৃতদাসটিকে বেঁধে ফেলে তাদের কাছে বন্দী করে রেখে দিল। উম্মু হাকীম এবার একাই বেরিয়ে পড়লেন ইয়ামেনের পথে ইকরিমার খোঁজে। ভু দূরের পথ, রাত আর দিন দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে অবশেষে তিনি লোহিত সাগরের তীরে তিহামা নামের একটি এলাকায় ইকরিমাকে ধরতে পারলেন। ইকরিমা তখন সাগর পাড়ি দেবার জন্য একজন মুসলিম নাবিকের সাথে বাদানুবাদ করছিলেন। নাবিকটি বলছিল, ”আগে আপনি পবিত্র হয়ে আসুন, তবেই আমি আপনাকে নিয়ে সাগরে নামব।”
”কিন্তু আমি কিভাবে পবিত্র হব?”
”আপনি এ কথার সাক্ষ্যদান করুন যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।”
”আমি তো এর জন্যই এখানে পালিয়ে এসেছি।”
ইতিমধ্যেই দুজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন উম্মু হাকীম। বললেন, ”আমার চাচাতো ভাই (আত্মীয়তার দিক দিয়ে এরা দুজন চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন), আজ আমি আপনার কাছে এসেছি সেই অনন্য সাধারণ, সবচেয়ে সঠিক পথের দিশারী আর সব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ইবন্ আদুল্লাহর কাছ থেকে। আমি তাঁর কাছে আপনার জন্য নিরাপত্তা চেয়েছি, তিনি তা দিয়েছেন। এখন আপনি আর নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবেন না।”
ইকরিমা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এতদূরে তাঁর স্ত্রীর একাকী উপস্থিতিতে। মুহম্মাদ, যাঁর সাথে তার এত শত্রুতা, যিনি তাকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষনা করেছেন তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা; তিনি নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ”তুমি কি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছ?” উম্মু হাকীম উত্তর করলেন, ”হ্যাঁ, আমি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছি এবং তিনি নিজেই আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।” ইকরিমা ফিরে চললেন মক্কার পথে। পথে উম্মু হাকীম সেই গৃক ভৃত্যের কথা স্বামীকে জানালেন। ভয়াবহ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন ইকরিমা, সরাসরি সে এলাকায় চলে গেলেন যেখানে ভৃত্যটি আটক অবস্থায় ছিল। ইকরিমা তাকে সেখানে হত্যা করলেন এবং আবার এগিয়ে চললেন মক্কার পথে। পথিমধ্যে যেখানে তারা বিশ্রামের জন্য থেমেছিলেন, সেখানে এক রাতে স্ত্রীকে একান্তে পেতে চাইলেন। উম্মু হাকীম ছিটকে সরে এলেন এবং তার সাথে মিলিত হতে অস্বীকার করলেন। বললেন, ”আপনি আমার সাথে মিলিত হতে পারবেন না, কারণ আমি মুসলিমা আর আপনি হলেন মুশরিক।”
ইকরিমা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী মুসলিম হয়েছে একেবারেই সেদিন, আর তাঁরা দুজন মিলিত হলে আর তো কেউ দেখছে না, ঈমান তাকে এতটুকু পরিবর্তন করেছে? বললেন, ”এ তো কোন সহজ বিষয় নয় যা তোমার আর আমার মিলন আর এতদিনের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে”। ইকরিমা মক্কায় প্রবেশ করলেন।
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তার মক্কায় প্রবেশের আগেই সাহাবীদের ডেকে ঘোষণা দিলেন, ”ইকরিমাহ্ ইবন্ আবী জাহল তোমাদের মধ্যে মুসলিম এবং মুহাজির হয়ে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গাল দিও না, কেননা মৃতকে গাল দিলে তা তাদের কাছে পৌঁছায় না।”
কিছুক্ষনের মধ্যে ইকরিমা সেখানে প্রবেশ করলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বসে ছিলেন। নবী, তাঁর উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক, উঠে দাড়ালেন এবং উষ্ণ আলিঙ্গনে ইকরিমাকে স্বাগত জানালেন।
“মুহাম্মাদ”, ইকরিমা বললেন, “উম্মু হাকীম আমাকে জানিয়েছে যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ, সে সত্য বলেছে।” রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন, “তুমি নিরাপদ।”
“আপনি মানুষকে কিসের দিকে ডাকছেন?”
“আমি তোমাকে আহ্বান জানাচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল এ কথার সাক্ষ্য দেবার জন্য, সালাত কায়েম করার জন্য, যাকাত আদায় করার জন্য এবং ইসলামের অন্যান্য বিধিনিষেধগুলো মেনে চলার জন্য।”
“আল্লাহর শপথ”, ইকরিমা বলে চললেন, “আপনি কেবলমাত্র তার দিকেই ডেকেছেন যা সত্য এবং আপনি কেবলমাত্র সৎকাজেরই আদেশ দান করেছেন। আপনার মিশন শুরু করার আগেও আপনি আমাদেরই মাঝে ছিলেন এবং তখন আপনি কথায় ছিলেন সবচেয়ে সত্যবাদী এবং কাজে ছিলেন সবচেয়ে সঠিক।” ইকরিমা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দিকে তার হাত প্রসারিত করে দিলেন এবং বলে চললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল”। এরপর বললেন,
“ইয়া রাসুলুল্লাহ্ , আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্রুতা ক্ষমা করে দেন এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।”
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, “হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্রুতা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে তার জন্যও তাকে ক্ষমা করে দাও।”
ইকরিমার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “আল্লাহর শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহর পথের শত্র“তার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুন আমি ব্যয় করব আল্লাহর পথে, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুন আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব।”
সেদিন থেকে ইকরিমা একনিষ্ঠভাবে ইসলামের প্রবেশ করলেন। মুসলিম হিসাবে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি জীবন বাজী রেখে অংশ নিতে লাগলেন এবং তাঁর দ্রুতগামী ঘোড়া অবিশ্বাসীদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে তুলতে লাগল। যুদ্ধ ময়দানে না থাকলে অধিকাংশ দিন তাঁর দিনের বেলা কাটত রোজা রেখে, মসজিদে ও কুরআন অধ্যয়ন করে, আর রাত কাটত নিভৃতে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে। তখন কুরআন কোন বই আকারে ছিল না, তা ছিল চামড়া, বড় উটের হাড়, উপযুক্ত কোন পাথর ইত্যাদিতে লিখিত অবস্থায়। কুরআনের সে সংরক্ষিত অংশগুলোকে বলা হয় মুসাফ। ইকরিমা প্রয়ই এ মুসাফগুলোকে নিজের চুমু খেয়ে, মুখের উপর রেখে অঝোর ধারায় কাঁদতেন আর বলতেন, ”কিতাবু রাব্বী, কালামু রাব্বী”, ”এ আমার রবের কিতাব, এ আমার রবের ভাষা”।
ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরিমা যে ওয়াদা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে করেছিলেন, তার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য তিনি ভীষণ কঠোর ও দৃঢ় ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর যতগুলো যুদ্ধ মুসলিম বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে তার প্রতিটিতেই তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অকুতোভয় প্রথম সারির যোদ্ধা।
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় দিকে দিকে ধর্মত্যাগীদের ফিতনা দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে। কোমল হৃদয় আবু বকর আল্লাহর কৃপায় তা অসাধারণ কঠোর হাতে দমন করেন। এ সময় আরবের অধিকাংশ অঞ্চলে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইকরিমা ছিলেন মুসলিম সেনাদলের অন্যতম সমরবিদ ও যোদ্ধা। আবু বকরের পর উমর এর খিলাফত শুরু হল। এককালের প্রবল পরাক্রান্ত রোমান আর পার্শিয়ান সম্রাজ্য তখন মুসলিমদের হাতে নাস্তানাবুদ অবস্থা। সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিমদের যে ভয়াবহতম ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংগঠিত হয় তা ছিল ইয়ারমুকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ইকরিমার কথা বর্ণনা করার আগে এর ঐতিহাসিক কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করা জরুরী।
নব্বই দশক পর্যন্ত যেমন এ পৃথিবী আমেরিকা ও সোভিয়েত এ দুটি সুপার পাওয়ারে বিভক্ত ছিল, ঠিক তেমনি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) যখন এ পৃথিবীতে ইসলামের বার্তা নিয়ে আসেন তখন পৃথিবী রোমান এবং পারস্য এ দুটি সাম্রাজ্যের সুপার পাওয়ারে বিভক্ত ছিল। বিশাল সিরিয়ান অঞ্চল, যা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সময় শাম নামে পরিচিত ছিল তা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীন এবং ইরাকের কিছু অংশ এবং ইরান ও এর সংলগ্ন এলাকাগুলো ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। এ দুটি শক্তি দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ এ দুটি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। সম্পদ, মর্যাদা, সামরিক শক্তি, ক্ষমতা সবদিক থেকে এ জাতি দুটো ছিলো সবার চেয়ে অগ্রগামী। এ দুটি সাম্রাজ্যের শাসিত অঞ্চলগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য়ে অতুলনীয়। আরব জাতি ছিলো ভৌগলিকভাবে এ দুটো জাতিরই প্রতিবেশী। রোমানরা এবং পারসিকরা আরব জাতিকে অসভ্য একটি জাতি হিসাবে জানত, আরবীয়দের সাথে তারা মিশতে চাইতো না এবং তাদের রাজসভায় আরবীয়দের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ছিল। আরবীয়রাও এ দুটি সাম্রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের ক্ষমতাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলত। আরবীয় কয়েকটি গোষ্ঠীর রাজা এবং স্থানীয় শাসকবর্গ রোমান অথবা পারসিকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের শাসন মেনে ও কর দিয়ে চলতো। এহেন অবস্থায় রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর আগমন ঘটল এ পৃথিবীতে। ইসলামের প্রচারের প্রথমদিকে তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকে ডেকে বলতেন, “তোমরা ইসলামের ছায়াতলে এসে আল্লাহর সার্বভৌমত্যকে মেনে নাও। আল্লাহর শপথ, একদিন পারসিক ও রোমানদের সম্পদ আল্লাহ্ তোমাদের হাতে তুলে দেবেন।”। তাঁর কথা শুনে অবিশ্বাসীরা হাসত, কেউ কেউ আরবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী লোকটি কেন এমন কথা বলছে তা ভেবে বিস্মিত হতো। ধীরে ধীরে ইসলামের আলো বিকশিত হতে লাগল, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) দূত পাঠিয়ে সকলকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে লাগলেন। এভাবে একদিন রোমান এবং পারসিক সম্রাটের কাছেও তাঁর দূত পৌঁছে গেলো। যে আরবদের তারা ঘৃনা করে সে আরবদের এমন ঔদ্ধত্য তারা মেনে নিতে পারে নি। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফতকালে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যাচারিত জনপদের লোকদের আহবানে সাড়া দিয়ে যুগপতভাবে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যে আক্রমন শুরু করলো। প্রথমদিকে পারস্য অঞ্চলের যুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ (রাঃ)। এরপর তিনি মুসান্না ইবন্ হারিসার হাতে মুসলিম কমান্ড ন্যাস্ত করে চলে আসেন রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এবং সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররা। একের পর এক যুদ্ধ হতে লাগল এবং যৎসামান্ন রসদ, স্বল্প সেনাদল নিয়েও মুসলিমরা এ দুটি সাম্রজ্যের অধীন রাষ্ট্রগুলো জয় করতে লাগল। পারস্য সাম্রজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটি হয়েছিল তা ছিল কাদেসিয়ার যুদ্ধ এবং রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ভয়ংকরতম যুদ্ধটি ছিল ইতিহাস বিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধ।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবার আগে মুসলিম সেনাদল রোমানদের রাজ্য একে একে জয় করছিলো। ইসলামের এ বিজয় যখন আর রোধ করা যাচ্ছে না, তখন সুবিশাল রোমান সাম্রজ্যের সকল অংশ থেকে সেনাদল নিয়ে এসে জড়ো করা হল ইয়ারমুকের প্রান্তরে। প্রায় দেড় লাখ আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত রোমান সেনা মাত্র তেত্রিশ হাজার মুসলিমের বাহিনী মোকাবেলা করার জন্য হাজির হল। ইসলামের ইতিহাসে কঠিনতম সে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য বীর মুসলিম মুজাহিদ কমান্ডার খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ কমান্ড গ্রহণ করলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররার কাছ থেকে। ইকরিমা এ যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একজন কমান্ডার। মরুভূমিতে পানিবিহীন পথচলার পর পথিক যেভাবে পানির জন্য ক্ষিপ্র হয়ে ছুটে চলে, এ যুদ্ধে ইকরিমাও তেমনি বার বার তার সেনাদল নিয়ে রোমানদের আক্রমন করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যয়ে রোমান সেনাদল আক্রমন করে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সুরক্ষিত রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে প্রবেশ করবেন এবং নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতি করবেন। ইকরিমার এ সংকল্পের কথা শুনে খালিদ দ্রুত তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “একাজ তুমি করো না ইকরিমা, তোমার মৃত্যু হবে মুসলিমদের জন্য একটা বড় আঘাত”। ইকরিমা বললেন,”আমাকে যেতে দাও খালিদ, আল্লাহর রাসুলের সাথে থাকার এবং তার সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ তুমি পেয়েছো। আমার বাবা আর আমি ছিলাম তার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু। যে পাপ আমি করেছি তার শোধ দেবার সুযোগ তুমি আমাকে দাও। আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে আমি অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি, আর আজ আমি এ রোমানদের দেখে পালিয়ে যাব তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।”
ইকরিমা তখন বাহিনীর লোকদের ডেকে বললেন, “কে কে আছো যে মৃত্যুর জন্য বায়াত করবে আমার হাতে”। তার এই আহ্বানে আল হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া সহ চারশো মুজাহিদ তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এলো। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ দলটি সবাইকে ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে এবং বীরের মত যুদ্ধ করল প্রতিটি লোক নিজের মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ দলটির দ্বারা রোমান বাহিনীর যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা আর তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সেদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দেখা গেল, মুসলিমদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করেছে তাদের মধ্যে তিনজন মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এই তিনজন ছিলেন আল হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া এবং ইকরিমা ইবন্ আবু জাহল। ইকরিমার খোঁজ পেয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ তার মাথা নিজ কোলে তুলে নিলেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। ইকরিমা এবং আল হারিস পানির জন্য ডাকছিলেন। তাঁদের জন্য দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হল। পানি আনার পর আইয়াশ তাঁদের দিকে তাকালেন। তারা বললেন, “এ পানি আইয়াশকে দাও।” আইয়াশের কাছে পানি নিয়ে যাবার পর দেখা গেল তিনি ততক্ষনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছেন। আবার পানি যখন ইকরিমা এবং আল হারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন দেখা গেল তাঁরা দুজনও ততক্ষনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন।
উপস্থিত মুসলিমদের চোখ আবেগে অশ্র“সজল হয়ে উঠল। তাদের মনে পড়লো ইকরামার অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের কথা। একদিন যে লোকটির হাত আল্লাহর কথাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য রক্ত ঝরাতো, আজ তার দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সে দিয়ে গেছে আল্লাহর জন্য।
রেফারেন্সঃ
আসহাবে রাসুলের জীবনকথাঃ ডঃআবদুল মা’বুদ
সাহাবীদের জীবনীঃ তালিব আল হাশিমি
No comments